লাস ভেগাস ও ইয়োসেমিটি ন্যাশনাল পার্ক - ৩


ছবি ১। ফারনেস ক্রিক র্যাঞ্চ যেখান টায় সকালের খাবার খেয়েছিলাম

ইয়োসিমিটি ন্যাশনাল পার্ক নেভাডাতেই অবস্থিত। লাস ভেগাস শহরটা থেকে বেরিয়ে আমরা রওনা দিলাম ইয়োসিমিটি ন্যাশনাল পাকের্র উদ্দেশ্যে।

ভীষন লম্বা পথ। পথের মাঝখানে পড়ল ডেথ ভ্যালী নামে একটা জায়গা। চারপাশের পাহাড় ঘিরে একটা চুল্লীর মতন একটা জায়গা তৈরী করেছে। রোদের তাপ এখানে চারিদিকে প্রতিফলিত হয়ে আগুন গরম করে ফেলে যায়গাটাকে। এখানকার একমাত্র র্যাঞ্চে নেমে আমরা সকালের খাবারটা করে নিলাম। বিভিন্ন ফলমূল দিয়ে ব্রেকফাস্টটা ভালই হল।


ছবি ২। সেখানটাতে একটা পুরোনো স্মৃতি কাঠের ট্রেনের বগির সামনে

তারপর আবার যাত্রা। দুপাশের পাহাড় আর ধুলি ধুসরিত মরুভুমির মধ্যে দিয়ে যেতে ভালই লাগছিল।


ছবি ৩। রাস্তায় পৃথিবীর সবচে নীচু জায়গাটার দিকে


ছবি ৪। স্যান্ড ডিউনে অভয়

কিছুদুর যাবার পর একটা বড় মরুভূমি - স্যান্ড ডিউন চোখে পড়ল। আমরা নেমে বেশ কিছু দুর আগিয়ে গেলাম। মরুভুমি যে কি ভয়ঙ্কর হতে পারে কিছুটা হলেও তার স্বাদ পেলাম। বালি গুলো যখন ভীতরে ঢুকছিল তখন মনে হচ্ছিল আগুন ঢুকছে। বিভিন্ন যায়গায় সাপের গর্ত দেখতে পাচ্ছিলাম। গাগান ইতিমধ্যে অসুস্থ বোধ করছিল। তাই তাকে আর ডাকা হয়নি। আমি সহ বেশীরভাগ মরুভুমি থেকে আগে ভাগেই ফিরে এলাম - ভীষন কষ্ট বোধ হচ্ছিল। নীলেশ আর অমিত আরো বেশ অনেকখানি গিয়ে যখন ফিরল তখন তারা প্রায় মৃতপ্রায়।


ছবি ৫। স্যান্ড ডিউনে আমরা


ছবি ৬। স্যান্ড ডিউন


ছবি ৭। আবার রাস্তা


ছবি ৮। কিছু আউট ল

তারপর আবার যাত্রা। যাত্রার মাঝখানেই রাস্তাতে একটা যায়গা পড়ল - এখন নাম মনে পড়ছে না - যেটা পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু জায়গা। সমুদ্র সমতল থেকে কয়েক হাজার ফিট নীচে যায়গাটা। ফলশ্রুতিতে সবার কান বন্ধ হয়ে গেল।

এর মাঝে আমার স্ত্রীর ফোন এল অমিতের মোবাইলে। ওদের কে তো বলে যাইনি। আমার রুমমেট উজ্জ্বল ভাইকে খালি অমিতের মোবাইল নাম্বার দিয়ে এসেছিলাম। বলেছিলাম একান্ত প্রয়োজন না পড়লে বাসায় না জানাতে। কিন্তু আমার স্ত্রী আন্দাজ করেছিল কোন একটা ঘাপলা আছে, উজ্জ্বল ভাইকে চেপে ধরে ফোন নাম্বার বের করেছে। আমার স্ত্রী ভীষন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আমাকে ফোন করেছে। তাদের ধারনা কোথায় না কোথায় আমি যাচ্ছি, ভীষন বিপদ হতে পারে আমাদের, ইত্যাদি। কোনমতে তাকে আশ্বস্ত করে ফোন রেখে দিলাম।

মূল পথে যে রাস্তাটা দিয়ে যাবার কথা সে জায়গায় মোড় ঘুরতেই দেখি বড় করে সাইন দেয়া: warning: snow removed occasionally। তো আমরা পার্শ্ববতীর্ একটা দোকানে থেমে কি অবস্থা জানতে গেলাম। দোকানদার জানাল আসলেই এই রাস্তায় গেলে বরফে পথ বন্ধ পাবেন। সুতরাং ঘুরে অন্য একটি রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। আর সেটাতে যেতে প্রায় ঘন্টা চারেক বেশী সময় লাগবে। কি আর করা, তখন বাজে বিকেল চারটার মত। আর চার ঘন্টা মানে রাত আটটা নাগাদ পৌছে যাব ওখানে এটা ভেবে আবার যাত্রা শুরু করলাম আমরা।

কিছুদুর গিয়ে চোখে পড়ল ভীষন সুন্দর একটা লেক। ম্যাপে দেখলাম এর নাম হচ্ছে মনো লেক। সবার চেঁচামেচিতে গাড়ী থামিয়ে নামলাম মনো লেকে। কিন্তু কাছে যেতেই দেখি সাইনবোডের্ লেখা এক বিশেষ প্রজাতির মাছির প্রজনন ক্ষেত্র এই লেক। মাছি গুলো মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয় - সুতরাং কেউ যেন মাছির ডিম বা লার্ভা ধ্বংস না করে সে ব্যাপারে সর্তক করে দেয়া হয়েছে।


ছবি ৯। মনো লেক


ছবি ১০। মনো লেকে শিভা


ছবি ১১। মনো লেকে অভয়


ছবি ১২। মনো লেকে আমি


ছবি ১৩। মনো লেকে মানসী পাখিদের চিপস ছুঁড়ে দিচ্ছে


ছবি ১৪। মনো লেকে পাখিদের আক্রমন

এই মাছির ডিমগুলোর জন্য পুরো লেকের পাড় জুড়ে থকথকে কাদা আর ভীষন দুর্গন্ধ হয়ে আছে। মনো লেকের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে কোন এক চুনা পাথরের পাহাড়, তাই লেকের পানিতে মিশে আসে চুনা। সেই চুনা গুলো জমাট বেঁধে সাদা সাদা চুনা পাথরের ক্রিষ্টাল ডিপি তৈরী করে। দূর থেকে দেখে অসাধারন মনে হয়। কিন্তু কাছে এসে বোঝা গেল ধারালো, ভীষন পিচ্ছিল সেগুলো।

সবাই ধুমসে ছবি তুলতে লাগল সেখানে। আশেপাশে কিছু পাখি উড়ছিল। মানসী নামের মেয়েটি পাখিগুলোকে হাতের চিপস খাওয়াতে খাওয়াতে আশেপাশে পাখির মেলা বসে গেল। সেগুলো রিতীমত আক্রমন করে বসত আরেকটু হলে। আমরা সবাই গিয়ে পাখিগুলোকে তাড়িয়ে মানসীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসলাম।

পানি যারা পা ভিজিয়েছিলাম তাদের পায়ে চুনের সাদা আস্তর পড়তে শুরু করেছে দেখলাম। তাই খালি পায়েই গাড়িতে চড়ে বসলাম আমরা। আবার শুরু হল যাত্রা।

(চলবে)

(প্রথম প্রকাশ সামহোয়্যাইন ব্লগ ২০০৬-০৬-৩০)

লাস ভেগাস ও ইয়োসেমিটি ন্যাশনাল পার্ক - ২


ছবি ‌‌‌১। রাস্তায় তোলা কোন একটি শো এর বিজ্ঞাপন

তখন রাত ১টা-২টার মত বাজে। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল যে আমরা বোধহয় গিয়ে সবকিছু বন্ধ পাব লাস ভেগাসে। নীলেশকে কথাটা জানাতেই বলল 'ম্যান, চাঁদ থেকে একটা শহরকেই দেখা যায় সেটা হলো লাস ভেগাস।' বুঝলাম বাড়িয়ে বলছে, তবু কিছু বললাম না।

তিনজন ড্রাইভার ছিল আমাদের সাথে। আমি তখনও ইউএসএর ড্রাইভিং লাইসেনস পাইনি। ওরা তিনজন পালা করে গাড়ী চালাচ্ছিল। যারা গাড়ি চালাচ্ছিল না তাদের মধ্যে থেকে একজন করে ড্রাইভারের সাথে কথা বলছিল ডিরেকশন দিচ্ছিল, যাতে সে ঘুমিয়ে না পড়ে বা বোর না হয়ে যায়।


ছবি ২। আমি আর গাগান, বালাজিও ক্যাসিনোতে

রাত দুইটা নাগাদ আমরা লাস ভেগাসের কাছাকাছি এসে পড়ি। আলো ঝলমল রঙীন শহরটাকে দেখে বুঝলাম আমার সন্দেহ নিতান্তই অমূলক ছিল। দুর পাহাড়ের উপর থেকে ভীষন সুন্দর লাগছিল শহরটাকে। আমি ক্যামেরা বন্দী করেছিলাম দৃশ্যগুলো, কিন্তু ফ্ল্যাশ কার্ডটা হারিয়ে ফেলি এই যাত্রার পরের দিকে।

রাত তিনটা নাগাদ আমরা লাস ভেগাস শহরে পৌছে যাই। দেখে মনে হচ্ছিল সবে সন্ধ্যা হয়েছে। ছোটখাট কাপড় পড়া মেয়ে, দামী দামী পোশাকে ছেলেরা আর আলো ঝলমল চোখ ধাধানো বিলিডং গুলো দেখতে দেখতে আমরা গাড়ী পার্ক শেষে ডিনার খেয়ে নিলাম এক রেস্টুরেন্ট থেকে।

রাস্তায় বিভিন্ন দালালের অশ্লীল আহবান জানিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া কার্ড গুলোকে পাশ কাটিয়ে আমরা ঘুরতে লাগলাম শহরের আনাচ কানাচ। টের পেলাম সব কিছু খোলা হলেও বিভিন্ন ক্যাসিনো এবং হোটেলের আকর্ষনীয় শো গুলো কিন্তু ইতিমধ্যে শেষ। সুতরাং ঘুরে ঘুরে দেখা ছাড়া তেমন কিছু করার নেই।

লাস ভেগাসের আসল আকর্ষন হলো ক্যাসিনো গুলো। হরেক রকম জুয়া খেলার উপকরন ছড়ানো ছিটানো। সেই সঙ্গে সেখানে প্রায় প্রতি রাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, যেমন গান বাজনা, নাচ, সাকার্স ইত্যাদি হয়ে থাকে। সেই সাথে আছে মদ, নারী ইত্যাদি। আর আছে বিরাট বিরাট ৫ তারা, ৭ তারা হোটেল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লিকুইড ক্যাশের খেলা চলে এইখানে। সত্যিকারের মজা পেতে হলে নেশা থাকতে হবে এইসব বিষয়ে।


ছবি ৩। আমি কোন একটি হোটেলের-কাম-ক্যাসিনোর অভ্যন্তরে

খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার লক্ষ্য করলাম, মনে করুন আপনি ১০০ মিলিয়ন ডলার জিতে ফেললেন, সেটা আপনি সেইফলি, কোন ঝঞ্ঝাট ছাড়াই বাড়িতে নিতে পারবেন। সিকিউরিটির কোন অভাব নেই। অবশ্য ভিতরের কথা আর কতটুকুই বা জানি।

আমরা এই ক্যাসিনো, সেই হোটেল ঘুরে বেড়াতে লাগলাম আর মাতাল লোকদের পাগলামী দেখতে লাগলাম। দেখি এক মাতাল তার মাতাল র্গালফ্রেন্ডকে কিস করতে গিয়ে দুজনে মিলে ধরাম করে পড়ে গেল। মেয়েটার গেল দম বন্ধ হয়ে, তারপরেও হাসছে। পুলিশ এসে আবার দাঁড় করিয়ে দিল তাদের। কিছু ক্যাসিনোতে কিছু স্লট মেশিনে জুয়াও খেললাম। একবার ২ ডলারের মতো জিতেছি, কিন্তু খেলার নেশায় পেয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত হারতে হলো। সবচে বেশী জিতল গাগান, ২৫ সেন্টের মেশিনে খেলে পেয়েছে ৩১.২৫ ডলার। (ছবি - ৪)


ছবি ৪। গাগান আর শিভা ৩১.২৫ ডলার যেতার কুপন হাতে

এক হোটেলের এক বলরুমে পার্টি হচ্ছিল আমরা ঢুকতে চাইলাম বলল সরি স্যার ইউ আর নট ইন প্রপার ড্রেস। কি আর করব ব্যাথিত হৃদয়ে চলে এলাম।


ছবি ৫। আমরা মাদাম তুসোর জাদুঘরের সামনে, বন্ধ দেখে হতাশ

এভাবে ঘুরতে ঘুরতে সকাল সাতটা বেজে গেল। আর এক ঘন্টা লেগে গেল গাড়ী কোথায় রেখেছিলাম সেটা খুঁজে বের করতে। ভীষন টায়ার্ড লাগছিল, হাত পা মনে হয় ভেঙ্গে আসছিল। আটটা নাগাদ আমরা রওনা দিলাম ইয়েসোমিটির উদ্দেশ্যে। ঘন্টা আটেকের রাস্তা। আমাদের কারওরই কিন্তু গত রাতে ঘুম হয়নি। ঝিমাতে লাগলাম আমরা। তখনও খেয়াল করিনি যে যারা গাড়ি চালাবে তারাতো গতরাতে গাড়ি চালিয়েছেই আবার এক ফোটাও ঘুমায়নি। সামনে যে বিপদ পড়ে আছে তার ব্যাপারে তো কিছু জানতামই না। জানলে তো উলটো রওনা দিতাম ঘরের দিকে।



ছবি ৬। 'এই বুট পলিশ'...


ছবি ৭। হোটেল বালাজিও, সকাল ৭ টায়

(চলবে)

(প্রথম প্রকাশ সামহোয়্যারইন ব্লগ ২০০৬-০৫-২৩)

আমার সর্ম্পকে

  • আমি
  • বর্তমানে আছি
আমার প্রোফাইল